মানব উন্নয়নের প্রায় সকল সূচকেই বাংলাদেশের অগ্রগতি বৈশ্বিক পর্যায়ে সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রসহ প্রধান ১২টি উন্নয়ন সূচকের মধ্যে ১০টিতেই বাংলাদেশ আজ তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোসহ দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে অভুতপূর্ব সাফল্য বাংলাদেশকে আজ দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য নিরসন ও অন্তভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে অপরাপর দেশেরগুলোর সামনে।
সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে শিক্ষাই মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী (উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর) বিগত ৪৫ বছরে সামগ্রিক শিক্ষার হার ১৬.৮% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৪ সালে তা ৬৩%এ উন্নীত হয়েছে। ২০১৩ সালে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে এ হার ছিল ৭৮.৮৬%, যা পুরুষ শিক্ষার হার (৭৮.৬৭%) থেকেও বেশী।
কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ সাফল্য ইতিবাচক হলেও শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে এবং পরিতাপের বিষয় হলো শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে তেমন কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ অদ্যবধি নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলেই তা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিগত সাত বছরের শিক্ষা বাজেটে গড় বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১৩.৭%, যা ২০১০ সালে ছিল সর্বোচ্চ (১৬.৩%)। অন্যদিকে গত দুই দশকে জিডিপি’র মাত্র ২% শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়েছে। অথচ ইউনেস্ক’র পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের নূন্যতম ২০ শতাংশ হওয়া ব্যঞ্চনীয় এবং শিক্ষা খাতে ব্যয় মোট জিডিপি’র নূন্যতম ৬ শতাংশ হওয়া উচিত।
লেখচিত্র ১: শিক্ষা খাতে ব্যয়
(মোট বাজেট ও জিডিপি’র শতকরা হার)
শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বারাদ্দের দাবিটিও বিবেচনার দাবি রাখে। এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা বাজেটের সাথে প্রযুক্তি, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, ধর্মসহ নানাবিধ খাতকে জুড়ে দেয়া হয়। এমনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বাজেটে সামরিক বাহিনী পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের বারদ্দও ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ফলে বরাদ্দকৃত স্বল্প অর্থটুকুও ভাগাভাগি হয়ে যায় অন্যান্য খাতের সাথে। ২০০৭-০৮ ও ২০১১-১৩ অর্থবছরে শিক্ষার সাথে প্রযুক্তি এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তির সাথে স্বাস্থখাতকেও জুড়ে দেয়া হয়েছিল।
২০১০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত ৮৭১২ কোটি টাকার বাজেটের ৭৩৬০ কোটি টাকাই ব্যয় হয়েছে অনুন্নয়ন খাতে, অন্যদিকে উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে ১৩৫২ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অনুন্নয়ন খাতে এ বরাদ্দ দাড়িয়েছে ১১৮৯৩ কোটি টাকা, অন্যদিকে উন্নয়ন খাতে এ বরাদ্দ দাড়িয়েছে ৩৬৪৭ কোটি টাকা। এতে করে শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় এসে দাড়ায় ১২০০ টাকার’ও নিচে (২০১২ সাল)। ২০১১ সালে শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় ছিল ১০০০ টাকারও নিচে। বরাদ্দের ক্ষেত্রে উন্নয়ন খাতকে ক্রমাগত উপেক্ষা করা শিক্ষার মানোন্নয়নের বড় ধরণের প্রবিন্ধকতা সৃষ্টি করছে। শিক্ষা অবকাঠামোর দেখভাল, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ সরবরাহ ও সর্বোপরি শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োজিত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্তচারীর বেতন অনুন্নয়ন খাতের অংশ এবং এই ক্ষেত্রগুলোতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সীমিত সম্পদকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় উন্নয়ন খাতের তুলনায় বেশী হওয়াটা অনভিপ্রেত।
উচ্চশিক্ষাখাতে অর্থায়নের বিষয়টি আরো অপর্যাপ্ত। বাংলাদেশ মঞ্জুরী কমিশনের তথ্য অনুযায়ী শিক্ষাখাতের সমগ্র ব্যয়ের মাত্র ১১% ব্যয় করা হয় উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় খাতে প্রতিবছর, যা জিডিপি’র মাত্র ০.১২%। তাদের হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুণগত মান যথাযথ পর্যায়ে উন্নিত করতে হলে তার পরিমান হওয়া উচিত মোট জিডিপি’র ০.৩%। সে অনুযায়ী ২০১০ সালে উচ্চ শিক্ষাখাতে ব্যয়ের প্রয়োজন হতো ২২৪৬ কোটি টাকা (জিডিপি’র ০.৩)%, কিন্তু বাস্তবে ব্যয় হয়েছিলো ৮৯৮ কোটি টাকা যা জিডিপি’র ০.১২%।
উচ্চশিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গবেষণা কার্যক্রম, শিক্ষার এই খাতে খুবই লজ্জাজনক। ’মৌলিক গবেষণাশূন্য ১৫ গবেষণাকেন্দ্র’ শির্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় এক শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫টি গবেষণাগারের জন্য বরাদ্দ ছিল সাড়ে ২৪ লক্ষ টাকা যা মানসম্মত গবেষণা কাজ পরিচালনার জন্য নিতান্তই অপ্রতুল।
লেখচিত্র ২: শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ
সূত্র: বাজেটের সংক্ষিপ্তসার (বিভিন্ন বছর)
বাংলাদেশে প্রতি বছর যে প্রতিবছর যে সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা পাশ করে বের হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি বছর চাকরির যে সুযোগ সৃষ্টি হয়, তার অুনপাত অতিমাত্রায় অসম। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রতি বছর এ কারনে বেড়েই চলেছে। এ সংকট নিরসনে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।এবং সেই অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও আরো জোরদার কল্পে এখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
সারণী ১: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরণ প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রী সংখ্যা
সূত্র: শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
সামগ্রিক বিচারে, গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সময়োপযোগী পাঠ্যসূচি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষকদল তৈরি, উচ্চশিক্ষায় মানসম্পন্ন গবেষণা পরিচালনা- এসব কিছু নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা ক্ষেত্রের সকল পর্যায়ে পর্যাপ্ত বরাদ্দ অনস্বীকার্য।
লেখচিত্র ৩: শিক্ষা খাতে মাথাপিছু (ছাত্র-ছাত্রী) বরাদ্দ বাংলাদেশে
সুপারিশ
১. শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান যে অসমতা রয়েছে গ্রাম-শহর ও ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে তা দূর করা ও সকলের জন্য অভিন্ন মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। বাজেটে এক্ষেত্রে সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে;
২. শিক্ষা বাজেট থেকে ধর্ম, প্রযুক্তি আলাদা করতে হবে; বাজেটে শিক্ষাাবাজেট সম্পূর্ণ আলাদাভাবে প্রণয়ন করতে হবে।
৩. অনগ্রসর, দরিদ্র এলাকা ও শহরের বস্তির শিশুদের স্কুলে ভর্তি ও ঝরে পড়া রোধ, শিশু-শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করতে হবে;
৪. শিক্ষা প্রশাসনের কিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ এবং স্থানীয় জনগনের সমন্বয়ে পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় কমিটি করতে হবে।
৫. শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান সকল অনিয়ম ও দূর্ণীতি দূর করতে হবে;
৬. শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার জন্য ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী, শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতীয় বাজেটের ২০% অথবা জিডিড়ি’র ৫% বরাদ্দ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তবায়নযোগ্য রূপরেখা ঘোষণা করতে হবে।
গবেষণা ও প্রকাশনা: গবেষণা টাস্কফোর্স, গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন। টাস্কফোর্স সদস্য ও রিভিউ প্যানেল: মনোয়ার মোস্তফা, মো: শহীদ উল্লাহ্, মোসফিকুর রহমান ও এ. আর. আমান। থিম কনট্র্রিবিউটর: তানভীর আহমেদ। প্রকাশকাল: মে ২০১৫। ই-মেইল: ফবসড়পৎধঃরপ.নঁফমবঃ@মসধরষ.পড়স,
ওয়েব: িি.িফবসড়পৎধঃরপনঁফমবঃ.ড়ৎম